ফজরের নামাজের উত্তম সময় নিয়ে আমাদের মাঝে দুই ধরনের মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। এক পক্ষ বলছে অন্ধকার থাকতে আদায় করতে হবে, আর অন্য পক্ষ বলছে ভোর বা ফর্সা হওয়ার পর আদায় করতে হবে। আসলে ইসলাম তো মানুষের কথা মত চলে না, এখানে কেবল মাত্র আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এর কথাই গ্রহণযোগ্য। তাই আজকের আলোচনায় আমি আপনাদের সামনে ফজরের নামাজ নিয়ে কিছু সহীহ হাদীস তুলে ধরবো ও তার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করবো, যা আপনাদের কে সহজেই বুঝতে সাহায্য করবে যে কখন ফজরের সালাত আদায় করা উত্তম।
কখন ফজরের নামাজের উত্তম সময়?

শুরুতে আমরা কিছু সহীহ হাদীস দেখে নেই ফজরের নামাজ সম্পর্কে…
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুল সাঃ ফজরের সালাত আদায় করতেন। অতঃপর মহিলারা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘরে ফিরতেন। কিন্তু অন্ধকারের কারণে তাদেরকে চেনা যেত না।
মুমিনা মহিলারা চাদর মুড়ি দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ফজরের সালাতে উপস্থিত হতেন। অতঃপর যখন সালাত শেষ হতো, তখন তারা তাদের বাড়ি ফিরে যেতেন, কিন্তু অন্ধকারের কারণে তাদের কেউ চিনতে পারতো না।
আমরা একথা জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু কে রাসুল (সাঃ) এর সালাতের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুপুরে যোহরের সালাত আদায় করতেন। আসরের সালাত আদায় করতেন যখন সূর্য পরিষ্কার থাকতো। আর সূর্য ডুবে গেলে মাগরিব আদায় করতেন। আর এশায় যখন মানুষ বেশি হতো তখন তাড়াতাড়ি পড়তেন এবং লোক কম হলে দেরিতে আদায় করতেন। আর ফজর সালাত আদায় করতেন অন্ধকারে।
আবু বারযাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) ফজরের সালাত এমন সময় পড়তেন, যখন আমাদের কেউ পাশে বসা ব্যক্তি কে চিনতে পারতেন না, যাকে সে আগে থেকেই চেনে। তিনি ফজর সালাতে ৬০ থেকে ১০০ টি আয়াত তেলাওয়াত করতেন।
হাদীস গুলো স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে ফজরের সালাত আদায় করতেন এবং সালাত লম্বা ক্বিরাআত বিশিষ্ট হত। ফর্সা হওয়ার পর ফজরের সালাত আদায় করতে হবে এই মর্মে কোন সহীহ হাদীস নেই। কিছু সহীহ হাদিসের অপব্যাখ্যা করে কিছু মানুষ বলেছেন যে ফর্সা হউয়ার পর ফজরের সালাত আদায় করতে হবে। সামনে আমরা সেই হাদিস গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
একটু খেয়াল করলে অবাক হবেন যে, সারা বসর তারা দেরি করে ফর্সা হউয়ার পর নামাজ আদায় করলেও রমজান মাসে ঠিক আযানের পর মুহূর্তেই নামাজ আদায় করে। এটা কেমন নীতি? ফর্সা হউয়ার পর সালাত আদায় করা যদি উত্তম হয় তাহলে রমজান মাসে তার বেতিক্রম কেন হবে?
আরও পড়তে পারেনঃ ফজরের নামাজ কয় রাকাত ও কি কি? সুন্নত আগে না পরে?
এর বিপরীতে কয়েকটি জটিল হাদীস
রাফে ইবনে খাদীজ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ফজরের মাধ্যমে ফর্সা করো। কারণ এটা নেকির জন্য সবচেয়ে উত্তম।
অন্য হাদীসে এসেছে রাফে ইবনে খাদীজ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলাল (রাঃ) কে বললেন তুমি ফজরের সালাতের মাধ্যমে ফর্সা করো। যেন লোকেরা তাদের তীর নিক্ষেপের স্থান গুলো দেখতে পায়।
হাদীছ দুটো দ্বারা কি প্রমাণ হয় যে, সূর্য উঠবে উঠবে ভাব বা ফর্সা হবে এমন সময়ে সালাত আরম্ভ করতে হবে? নাকি সালাত শেষ হবে ফর্সা হওয়া অবস্থায়?
হেদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘ফর্সা করে ফজর সালাত আদায় করা মুস্তাহাব’ (হেদায়া, ১/৮০ পৃঃ)। তারা উক্ত হাদীসের অপব্যাখ্যা করে বলে, ফর্সা হওয়ার পর ফজরের সালাত আরম্ভ করতে হবে। এটা ব্যাখ্যার নামে অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আমাদের পূর্বের দেখে আশা একাধিক সহীহ হাদীসের বিরোধিতা করছে এই উক্তিটি।
অপব্যাখ্যার সঠিক ব্যাখ্যা
উম্মে ফারওয়া (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) -কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সবচেয়ে উত্তম আমল কোনটি? তখন নবী (সাঃ) বললেন, ‘সালাতের প্রথম সময়ে সালাত আদায় করা’
আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) আমাকে বললেন, তোমার আমীরগণ যখন সালাতকে মেরে ফেলবে (দেরী করে আদায় করবে), তখন তুমি কী করবে? আমি বললাম, আপনি কী আদেশ করেন? তখন নবী করীম (সাঃ) বললেন, তুমি যথাসময়ে সালাত আদায় করবে। অতঃপর সেই সালাতটাই যদি তাদের সাথে পড়ার সুযোগ পাও, তাহলে তা পড়ে নাও। তোমার জন্য তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল কী? নবী (সাঃ) বললেন, ‘নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা।
এই তিনটা হাদীস সামনে রাখলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যে, নবী করীম (সাঃ) সব সময় প্রথম দিকে বা নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করতে বলেছেন। মানে আযান হয়ে যাওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সালাত আদায় করে নেওয়া। এমনকি ইমাম যদি খুব বেশি দেড়ি করে ফেলে তাহলে নিজে নিজে পরে নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন।
এবার যদি আমরা ফজর সালাতের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখব, অন্ধকার থাকতেই ফজরের আযান হয়ে যায়। আযানের পর থেকে ফর্শা হউয়ার আগ পর্যন্ত অনেক লম্বা একটা সময়, যে সময়ে নবী করীম (সাঃ) ৬০ থেকে ১০০ আয়াত তেলওয়াত করতেন তার নামজে। তাহলে আযানের পর পর সালাত আদায় না করে আমরা যদি এই লম্বা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করি তাহলে কি রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাত অমান্য করা হয় না? অবশই হয়। তাহলে এবার একটু চিন্তা করেন যে, সুন্নাত অমান্য করে সেই ইবাদতের ফায়দা কত টুকু হতে পারে বা সেটা আদো গ্রহণযোগ্য হবে কিনা আল্লাহের কাছে।
তবে যোহর এবং এশার নামাজের ক্ষেত্রে নবী করীম (সাঃ) এর আলাদা কিছু নির্দেশনা রয়েছে। আমরা যোহর এবং এশার আলোচনায় সেগুলো সম্পর্কে জানব ইনশাআল্লাহ।
আরও পড়তে পারেনঃ ফজরের নামাজের নিয়ত করার সঠিক পদ্ধতি – আলোর সন্ধান
ইসফার বা ফর্সা এর অর্থ কি?
ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব (রাহঃ) বলেন, ইসফার তথা ফর্সা হওয়ার অর্থ হল, এমনভাবে ফজর স্পষ্ট হওয়া, যাতে কোন সন্দেহ না থাকে। তারা কেউ মনে করেননি যে, ইসফার অর্থ সালাত দেরি করে পড়া (তিরমিযী, হা/১৫৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
ইমাম ত্বাহাবী (রাহঃ বলেন, ফর্সা-এর অর্থ হল, অন্ধকারে ফজরের সালাত শুরু করা এবং ফর্সা হলে শেষ করা। যা আমরা রাসূল (সাঃ) ও তার সাহাবীগণ থেকে বর্ণনা করেছি। আর সেটাই আবু হানীফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রাহঃ) এর কথা। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা ফজরের মাধ্যমে ফর্সা কর। অর্থাৎ ফজরের সালাতে কিরাআত লম্বা কর। এর অর্থ এটা নয় যে, তারা যেন ফর্সা হওয়ার সময় সালাতে প্রবেশ করে। বরং ফর্সা হওয়ার সময় তারা সালাত থেকে বের হবে’ (ত্বাহাবী – ১০০৩)।
আলবানী (রাহঃ) বলেন, হাদীসের শব্দ সমূহ জমা করলে প্রমাণিত হয় যে, এর অর্থ হবে ফর্সা হওয়া পর্যন্ত সালাতের কিরাআত লম্বা করা। আর এভাবে ফর্সা করাই সবচেয়ে উত্তম এবং নেকীর দিক থেকে অধিক মর্যাদাপূর্ণ। যেমনটি পূর্বের শব্দগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, ইসফার অর্থ এটা নয় যে, ফর্সা করে সালাত শুরু করতে হবে , যেমনটি হানাফীদের মাঝে প্রচলিত আছে (ইরওয়াউল গালীল – ১/২৮৬ পৃঃ)
সন্মানিত ইসলামি চিন্তাবিদ ও ইমামগনের ব্যাখ্যা গুলো আরও পরিষ্কার করে দেয় ইসফার বা ফর্সা এর অর্থ। অতএব তাদের ব্যাখ্যা থেকেও এটা প্রমানিত হয় যে অন্ধকার থাকতেই ফজরের সালাত আদায় করতে হবে।
সারসংক্ষেপ
নিজের দলকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে কোরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা করা গুরুতর অপরাধ, যার জন্য রয়েছে আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তি। কিন্তু আমাদের এত টাই অধপতন হয়েছে যে আমরা দল বা মাজহাব কেই প্রাধান্য দিচ্ছি সহীস হাদীসের অপব্যাখ্যা করে।
আশা করি এই আলোচনা ও সহীহ হাদীস গুলো থেকে আপনারা এটা নিশ্চিত হয়েছেন যে ফজরের নামাজের উত্তম সময় হচ্ছে অন্ধকার থাকতেই আদায় করে নেওয়া। ফর্সা হওয়ার মুহূর্তে নামাজ শেষ হবে, শুরু নয়। আল্লাহ আমাদের দল-মত নির্বিশেষে বেশি বেশি আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন। আজ এখানেই শেষ করছি, ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে কথা হবে অন্য কোন বিষয় নিয়ে। আমাদের সাথেই থাকুন, কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ে তুলুন, আসসালামু-আলাইকুম।
জাযাকাল্লাহ। আপনার আলোচনা খুবই গঠনমূলক। আমাদের মতো কম জানা সাধারণ মানুষের কল্যাণে যথেষ্ট ভুমিকা রাখবে বলে আশা করি। আবারো আপনার মঙ্গল কামনা করছি।
জাযাকাল্লাহ প্রিয় পাঠক, দোয়া করবেন আমার জন্য যেন ভালো কিছু করতে পারি।
আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার তাওফিক দান করিও
আমীন