হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী এবং আরবে মুসলিমদের শক্তি সম্পর্কে জানান দেওয়া প্রথম সশস্ত্র সংঘর্ষ ছিল বদর। ইন্টারনেটে, বাংলায় বদর যুদ্ধ সম্পর্কে পরিপূর্ণ একটা আর্টিকেলের অভাব বোধ করলাম, এজন্যই চেষ্টা করলাম গভীর ভাবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে বদর যুদ্ধের কারণ, বিবরণ ও ফলাফল সম্পর্কে পর্যালোচনা করার। আশা করছি এ থেকে আপনারা সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন। পুরোটা পড়ার অনুরোধ রেখে শুরু করছি আজকের আলোচনা।
- বদর যুদ্ধ কত হিজরীতে সংঘটিত হয়
- বদর কোথায় অবস্থিত
- বদর যুদ্ধের কারণ কী
- বদর যুদ্ধের বিবরণ:
- মাদানী বাহিনীর অবস্থান ও পরামর্শ সভা:
- কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা:
- মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা:
- রওয়ানাকালে আবু জাহল:
- মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি:
- বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা:
- মাক্কী বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা:
- মুসলিম বাহিনী সারিবদ্ধ হ’ল:
- যুদ্ধ শুরু:
- যুদ্ধের প্রতীক চিহ্ন:
- ফেরেশতাগণের অবতরণ:
- ফেরেশতাগণের যুদ্ধে যােগদান:
- ফেরেশতা নাযিলের উদ্দেশ্য:
- মাক্কী বাহিনীর পলায়ন:
- বদর যুদ্ধের ফলাফল:
- বদর যুদ্ধে শহীদ সাহাবীদের নাম:
- নিহত কুরায়েশ নেতৃবৃন্দের কয়েকজন:
- প্রসিদ্ধ কুরায়েশ বন্দীদের কয়েকজন:
- মক্কায় পরাজয়ের খবর ও তার প্রতিক্রিয়া:
- মদীনায় বিজয়ের খবর:
- গণীমত বণ্টন:
- যুদ্ধবন্দী হত্যা:
- যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা:
- ১ম ঈদুল ফিৎর:
- বদর যুদ্ধের কুরআনের আয়াত:
- বদর যুদ্ধের গুরুত্ব:
- শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
- উপসংহার
বদর যুদ্ধ কত হিজরীতে সংঘটিত হয়?
হিজরতের অনধিক ১৯ মাস পর ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান শুক্রবার সকালে (৬২৪ খৃ. ১১ই মার্চ) ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছারসহ মােট ১৪ জন শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয় (আর-রাহীক ২২৪ পৃঃ ও ২১২ পৃঃ)।
বদর কোথায় অবস্থিত?
বদর হল মদীনা থেকে ১৬০ কি. মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম। যেখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। এখানেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসে তাওহীদ ও শিরকের মধ্যকার প্রথম সশস্ত্র মুকাবিলা।

বদর যুদ্ধের কারণ কী?
পরােক্ষ কারণগুলি:
(১) মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের পত্র প্রেরণ। রাসূল (ছাঃ)-এর আগমনের কারণে ইয়াছরিবের নেতৃত্ব লাভের মােক্ষম সুযােগটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি ছিলেন মনে মনে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি তার এই ক্ষোভটাকেই কুরায়েশরা কাজে লাগায় এবং নিম্নোক্ত ভাষায় কঠোর হুমকি দিয়ে তার নিকটে চিঠি পাঠায়।
‘তােমরা আমাদের লােকটিকে (মুহাম্মাদকে) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তােমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ও তাকে বের করে দিবে নতুবা আমরা তােমাদের উপরে সর্বশক্তি নিয়ে হামলা করব। তােমাদের যােদ্ধাদের হত্যা করব ও নারীদের হালাল করব। (৩৭৪, আবুদাউদ হা/৩০০৪)
এই পত্র পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দ্রুত তার সমমনাদের সাথে গােপন বৈঠকে বসে গেল। কিন্তু সংবাদ রাসূল (ছাঃ)-এর কানে পৌছে গেল। তিনি সরাসরি তাদের বৈঠকে এসে হাযির হলেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি দেখছি কুরায়েশদের হুমকিকে তােমরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছ। অথচ এর মাধ্যমে তােমরা নিজেরা নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, কুরায়েশরা তােমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না।
“তােমরা কি তােমাদের সন্তান ও ভাইদের সাথে (অর্থাৎ মুসলমানদের সাথে) যুদ্ধ করতে চাও? রাসূল (ছাঃ) এর মুখে এ বক্তব্য শুনে বৈঠক ভেঙ্গে গেল ও দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। (৩৭৪, আবুদাউদ হা/৩০০৪)
যদিও আব্দুল্লাহর অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলতে থাকল। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুনাফিক ও ইহূদীদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে থাকেন। যাতে হিংসার আগুন জ্বলে না ওঠে।
(২) আউস গােত্রের নেতা সা’দ বিন মু’আয (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় যান ও কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের অতিথি হন। উমাইয়ার ব্যবস্থাপনায় দুপুরে নিরিবিলি ত্বাওয়াফ করতে দেখে আবু জাহল তাকে ধমকের সুরে বলেন, “তােমাকে দেখছি মক্কায় বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করছ। অথচ তােমরা ধর্মত্যাগী লােকগুলােকে আশ্রয় দিয়েছ! … আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবু ছাফওয়ানের (উমাইয়া বিন খালাফের) সাথে না থাকতে, তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না’। একথা শুনে সা’দ চাক্কার দিয়ে বলে ওঠেন, তুমি আমাকে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমি তােমার জন্য এর চেয়ে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবাে। আর তাতে মদীনা হয়ে তােমাদের ব্যবসায়ের রাস্তা বন্ধ হবে’। (বুখারী হা/৩৯৫০)
(৩) কুরায়েশ নেতারা ও তাদের দোসররা হর-হামেশা তৎপর ছিল মুহাজিরগণের সর্বনাশ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রায়ই বিনিদ্র রজনী কাটাতেন। এক রাতে তিনি বললেন, “এ যদি আমার ছাহাবীগণের মধ্যে যােগ্য কেউ এসে আমাকে রাতে পাহারা দিত! আয়েশা (রাঃ) বলেন, এমন সময় হঠাৎ অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে? জবাব এল, আমি সা’দ ইবনু আবী ওয়াকক্কাছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কি উদ্দেশ্যে আগমন? সা’দ বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে আমার অন্তরে ভয় উপস্থিত হ’ল। তাই এসেছি তাকে পাহারা দেবার জন্য। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো’আ করলেন ও ঘুমিয়ে গেলেন। এমনকি আমরা তার নাক ডাকানাের শব্দ শুনতে পেলাম। (বুখারী হা/৭২৩১; মুসলিম হা/২৪১০)
এরপর থেকে এরূপ পাহারাদারীর ব্যবস্থা নিয়মিত চলতে থাকে। যতক্ষণ না নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়- ‘আল্লাহ তােমাকে লােকদের হামলা থেকে রক্ষা করবেন” (মায়েদাহ ৫/৬৭)। উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘হে লােক সকল! তােমরা ফিরে যাও। মহান আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন। (তিরমিযী হা/৩০৪৬)
কুরায়েশদের অপতৎপরতা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধেই ছিল না; বরং সাধারণ মুহাজির মুসলমানের বিরুদ্ধেও ছিল। আর এটাই স্বাভাবিক।
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিরিয়া ফেরত মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের পুরা খবরাখবর সগ্রহের জন্য তালহা বিন উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ বিন যায়েদকে প্রেরণ। করেন। তারা হাওরা’ নামক স্থানে পৌছে জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিরাট এক ব্যবসায়ী কাফেলা মক্কার পথে সত্বর ঐ স্থান অতিক্রম করবে। যাদেরকে ইতিপূর্বে যুল-“উশায়রা পর্যন্ত গিয়েও ধরা যায়নি। যে কাফেলায় রয়েছে এক হাযার উট বােঝাই কমপক্ষে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার মাল-সম্পদ এবং তাদের প্রহরায় রয়েছে আমর ইবনুল আছ সহ ৩০ থেকে ৪০ জন সশস্ত্র জোয়ান।
উল্লেখ্য যে, এই বাণিজ্যে মক্কার সকল নারী-পুরুষ অংশীদার ছিল। তারা দ্রুত মদীনায় ফিরে এসে রাসূল (ছাঃ)-কে এই খবর দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চিন্তা করলেন, এই বিপুল সম্পদ মক্কায় পৌঁছে গেলে তার প্রায় সবই ব্যবহার করা হবে মদীনায় মুহাজিরগণকে ধ্বংস করার কাজে। অতএব আর মােটেই কালক্ষেপণ না করে তিনি তখনই বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই কাফেলাকে আটকানাের জন্য। (ইবনু হিশাম ১/৬০৬, আর-রাহীক ২০৪ পৃঃ)
বদর যুদ্ধের বিবরণ:

বিগত অভিযানগুলির ন্যায় এ অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলাকে আটকানাে। তাই অন্যান্য অভিযানের মতই এটাকে ভাবা হয়েছিল। ফলে কেউ যােগ দিয়েছিল, কেউ দেয়নি এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাউকে অভিযানে যেতে বাধ্য করেননি। অবশেষে ৮ই রামাযান সােমবার অথবা ১২ই রামাযান শনিবার ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের একটি কাফেলা নিয়ে সাধারণ প্রস্তুতি সহ তিনি রওয়ানা হলেন। যার মধ্যে ৮২, ৮৩ অথবা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির এবং বাকীগণ ছিলেন আনছার। আনছারগণের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গােত্রের। (ইবনু হিশাম ২/৬১২; ইবনু সা’দ ২৮)
বি’রে সুইয়া নামক স্থানে এসে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কায়েস বিন আবু ছা’ছা’আহকে সংখ্যা গণনা করতে বললেন। পরে সংখ্যা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং বললেন, তালূতের সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল। (বুখারী হা/৩৯৫৯)
তিন শতাধিক লােকের এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘােড়া ছিল যুবায়ের ইবনুল আওয়াম ও মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদের এবং ৭০টি উট ছিল। যাতে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (ছাঃ), আলী ও আবু লুবাবাহ এবং পরবর্তীতে তার বদলে মারছাদ বিন আবু মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (ছাঃ) নিজেও হাঁটতেন। এ সময় মদীনার আমীর নিযুক্ত হন অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ)।
মাদানী বাহিনীর অবস্থান ও পরামর্শ সভা:
আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার নিরাপদে নিষ্ক্রমন এবং আবু জাহলের নেতৃত্বে মাক্কী বাহিনীর দ্রুত ধেয়ে আসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাফরানে অবস্থানকালেই অবহিত হন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে তিনি মদীনা থেকে ৬৮ কি. মি. দক্ষিণে রাওহা’ তে অবতরণ করে উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহ্বান করলেন’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সুরা আনফাল ৭ আয়াত)। কেননা তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে মদীনা থেকে বের হননি।
মুহাজিরগণের মধ্যে হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাদের মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করলেন। অতঃপর মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বললেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানাে পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, “তুমি ও তােমার রব যাও গিয়ে যুদ্ধ কর! আমরা এখানে বসে রইলাম (মায়েদাহ ৫/২৪)।
বরং আমরা বলব, আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধরত থাকব’। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। মিকদাদের এই জোরালাে বক্তব্য শুনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই প্রীত হলেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো’আ করলেন’ (আহমাদ হা/১৮৮৪৭)
সংখ্যালঘু মুহাজিরগণের উপরােক্ত তিন নেতার বক্তব্য শােনার পর সংখ্যাগুরু আনছারদের পরামর্শ চাইলে আউস গােত্রের নেতা সা’দ বিন মু’আয (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনছারগণ কেবল (মদীনা) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে। জেনে রাখুন, আমি আনছারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে চান সেখানে আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে চান আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুনসর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবুও আমরা আপনার সাথেই থাকব। “যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাপিয়ে পড়ব”। ‘আমাদের একজন লােকও পিছিয়ে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন।
সা’দের উক্ত কথা শুনে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হ’লেন ও উদ্দীপিত হয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রহমতের উপর তােমরা বেরিয়ে পড়ে এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা’আলা আমাকে দু’টি দলের। কোন একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলাে দেখতে পাচ্ছি’। (ইবনু হিশাম ১/৬১৫)
একথাটি কুরআনে এসেছে এভাবে;
“আর যখন আল্লাহ দুটি দলের একটির ব্যাপারে তােমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সেটি তােমাদের হস্তগত হবে। আর তােমরা কামনা করছিলে যে, যাতে কোনরূপ কণ্টক নেই, সেটাই তােমাদের ভাগে আসুক (অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে তােমরা জয়ী হও)। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে (প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) সত্যে পরিণত করতে এবং কাফিরদের মূল কর্তন করে দিতে। যাতে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপাচারীরা এটাকে অপসন্দ করে’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
পরামর্শ সভায় আবু আইয়ুব আনছারীসহ কিছু ছাহাবী বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় এবং এই অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেননা তারা এসেছিলেন বাণিজ্য কাফেলা আটকানাের জন্য, বড় ধরনের কোন যুদ্ধ করার জন্য নয়। কিন্তু আল্লাহ এতে নাখােশ হয়ে আয়াত নাযিল করেন,
যেমনভাবে তােমাকে তােমার গৃহ থেকে তােমার পালনকর্তা বের করে এনেছেন সত্য সহকারে। অথচ মুমিনদের একটি দল তাতে অনীহ ছিল। তারা তােমার সাথে বিবাদ করছিল সত্য বিষয়টি (অর্থাৎ যুদ্ধ) প্রকাশিত হওয়ার পর। তাদেরকে যেন মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তারা যেন তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। (আনফাল ৮/৫-৬)
এভাবে আল্লাহ কোনরূপ পূর্ব ঘােষণা ও প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই উভয় বাহিনীকে মুখােমুখি করে দিলেন। যার মধ্যে ছিল তার একটি অত্যন্ত দূরদর্শী পরিকল্পনা।
যেমন আল্লাহ বলেন;
‘স্মরণ কর, যখন তােমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তােমাদের নিম্নভূমিতে। যদি তােমরা উভয় দল আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ হ’তে, তাহলে (সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে) তােমরা সে ওয়াদা রক্ষায় মতবিরােধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হয় সে যেন (ইসলামের) সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধবংস হয় এবং যে বেঁচে থাকে সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’ (আনফাল ৮/৪২)।
পরামর্শ সভায় সবধরনের মতামত আসতে পারে। এটা কোন দোষের ছিল না। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে এই সামান্যতম ভীরুতাকেও আল্লাহ পসন্দ করেননি। তাই উপরােক্ত ধমকিপূর্ণ আয়াত নাযিল হয়। যা ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান শতগুণে বৃদ্ধি করে।
পরামর্শ সভায় যুদ্ধে অগ্রগমনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আবু লুবাবাহ ইবনু আব্দিল মুনযিরকে “আমীর নিযুক্ত করে মদীনায় ফেরৎ পাঠানাে হয়। অতঃপর কাফেলার মূল। পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনায় প্রথম দাঈ মুছ’আব বিন ওমায়ের (রাঃ) কে।
কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা:
কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে তিনি যামযাম বিন আমর আল-গিফারী কে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন এবং মাজদী বিন আমর এর কাছে মদীনা বাহিনীর খবর নেন।
তার কাছে জানতে পারেন যে, দু’জন উদ্ৰারােহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গােবর থেকে খেজুরের আঁটি খুঁজে বের করে বুঝে নে যে, এটি মদীনার উটের গােবর। ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরকে বামে রেখে মূল রাস্তা ছেড়ে ডাইনে পশ্চিম দিকে উপকূলের পথ ধরে দ্রুত চলে গেলেন। এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হলেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানাে খবরের কারণে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়। (আর-রাহক ২০৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১৮)
মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা:
আবু সুফিয়ানের প্রথম পত্র পেয়ে বাণিজ্য কাফেলা উদ্ধারের জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য আবু জাহলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফেীজ রওয়ানা হয়ে যায়। অতঃপর রাবেগ-এর পূর্ব দিকে জুহফা নামক স্থানে পৌছলে পত্রবাহকের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু আবু জাহলের দম্ভের সামনে কারু মতামত গ্রাহ্য হ’ল না। তবু তার আদেশ অমান্য করে আখনাস বিন শারীত্ব আছ-ছাক্বাফী এর নেতৃত্বে বনু যােহরা গােত্রের ৩০০ লােক মক্কায় ফিরে গেল।
বনু হাশেমও ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু মুহাম্মাদ-এর স্বগােত্র হওয়ায় তাদের উপরে আবু জাহলের কঠোরতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে তারা ক্ষান্ত হন।
আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং দর্পভরে বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমােদ-ফুর্তি করে পান ভােজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে।
এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শাে অশ্বারােহী, ছয়শাে লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ৯টি বা ১০টি করে উট যবেহ করত।
আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় সকল গােত্রের লােকদের মালামাল ছিল। তাছাড়া মাক্কী বাহিনীতে বনু ‘আদী ব্যতীত কুরায়েশদের সকল গােত্রের লােক বা তাদের প্রতিনিধি যােগদান করেছিল। অথবা যােগদানে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আব্বাস, হযরত আলীর দু’ভাই জ্বালেব ও আক্বীল। রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা আবুল আছ সহ বনু হাশেমের লােকেরা, তারা আসতে অনিচ্ছুক ছিলেন। নেতাদের মধ্যে কেবল আবু লাহাব যাননি। তিনি তার বদলে তার কাছে ঋণগ্রস্ত একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন। (ইবনু হিশাম ১/৬১৮-১৯)
রওয়ানাকালে আবু জাহল:
আবু জাহল মক্কা থেকে রওয়ানার সময় দলবল নিয়ে কা’বাগৃহের গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিল ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের মধ্যেকার সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে। “হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের উপরে থাকে, তবে তুমি তাকে সাহায্য কর। আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য কর’। হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের দু’দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে’। (ইবনু হিশাম ১/৬৬৮)
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবু জাহল আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসাবে বিশ্বাস করত। যাকে ‘তওহীদে রুবুবিয়াত’ বলা হয়। এর ফলে কেউ মুসলমান হতে পারে না। কেননা মুসলিম হওয়ার জন্য তওহীদে ইবাদত’-এর উপর ঈমান আনা জরুরি। যার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করতে স্বীকৃত হয়। সেই সাথে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর ঈমান ও তাঁর আনীত শরী’আতের বিধানসমূহ পালন করা অপরিহার্য।
রওয়ানা হওয়ার সময় তাদের মনে পড়ল বনু বকর গােত্রের কথা। যাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। পথিমধ্যে তারা হামলা করতে পারে। ফলে মাক্কী বাহিনী দ্বিধা-দ্বন্মে পড়ে গেল। কিন্তু শয়তানী প্ররােচনায় গর্বোদ্ধত হয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল।
এভাবে শয়তান মানুষের অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করে। যাতে তার স্বাভাবিক বােধশক্তি লুপ্ত হয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়। যেমন বদরের যুদ্ধে শয়তানের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শােভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আজ লােকদের মধ্যে তােমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কেউ নেই। আর আমি তােমাদের সাথে আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখােমুখী হ’ল, তখন সে পিছন ফিরে পালালাে এবং বলল, আমি তােমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তােমরা তা দেখােনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।
বস্তুতঃ আবু জাহল শয়তানের ধোকায় পড়েই রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রওয়ানা হয়েছিল। অতঃপর কুরায়েশ বাহিনী যথারীতি দ্রুতবেগে এসে বদর উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির সন্নিবেশ করে।
মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি:
রাওহাতে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। অতঃপর ‘ছাফরা’ টিলা সমূহ অতিক্রম করে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি বাসবাস বিন আমর আল-জুহানী এবং ‘আদী বিন আবুয যাগবা আল-জুহানীকে বদরের খবরাখবর নেবার জন্য পাঠান” (মুসলিম হা/১৯০১)।
এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী, যুবায়ের ও সা’দ বিন আবু ওয়াকক্কাছের নেতৃত্বে একটি গােয়েন্দা দল পাঠান শত্রুপক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লােক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তারা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, এরা আবু সুফিয়ানের লােক নয়। বরং তারা কুরায়েশ বাহিনীর লােক। কুরায়েশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তাদের জন্য সে উটের পিঠে করে পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। (ইবনু হিশাম ১/৬১৬)
তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি আবু জাহল, উৎবা, শায়বা, উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি জানতে পারেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন, “এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান, এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তাদের নিহতদের কেউই উক্ত ইশারার স্থান থেকে দূরে যেতে পারেনি। (মুসলিম হা/১৭৭৯)
তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টা অথবা দশটা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাযার-এর মধ্যে হবে। কেননা একটি উট ১০০ জনের বা তার কাছাকাছিদের জন্য। (আহমাদ হা/৯৪৮)
এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নিল, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই। অতঃপর আউস নেতা সা’দ বিন মু’আ (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি উঁচু টিলার উপরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করা হ’ল। সেখানে তার সাথে কেবল আবুবকর (রাঃ) রইলেন এবং পাহারায় রইলেন সা’দ বিন মুআয-এর নেতৃত্বে একদল আনছার যুবক।
সাদ সেখানে বিশেষ সওয়ারীও প্রস্তুত রাখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহলে আপনি এই সওয়ারীতে করে দ্রুত মদীনায় চলে যাবেন। কেননা ‘সেখানে রয়েছে হে আল্লাহ্র নবী! আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী একদল ভাই। তারা আপনার শুভাকাংখী এবং তারা আপনার সঙ্গে থেকে জিহাদ করবে’। সা’দের এ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হ’লেন ও তার জন্য কল্যাণের দো’আ করলেন। (ইবনু হিশাম ১/৬২০-২১)
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেনাদলকে বিন্যস্ত করেন এবং সুষ্ঠুভাবে শিবির সন্নিবেশ করেন।
বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা:
বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ সামান্য বৃষ্টি এলাে। মুসলিম বাহিনী কেউ গাছের নীচে কেউ ঢালের নীচে ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্তুত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে দৃঢ় হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এল। সেই সাথে অধিকহারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তিনি তার পক্ষ থেকে প্রশান্তির জন্য তােমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং তােমাদের উপরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তােমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তােমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য, তােমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তােমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রাখার জন্য’ (আনফাল ৮/১১)।
শয়তানের কুমন্ত্রণা এই যে, সে যেন দুর্বলচিত্ত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেবার সুযােগ না পায় যে, আমরা যদি আল্লাহর বন্ধু হই, তাহলে আমরা এই নিম্নভূমিতে ধূলি-কাদার মধ্যে কেন থাকব? অথচ কুরায়েশরা কাফের হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ ভূমিতে আছে। তারা উট যবেহ করে খাচ্ছে আর ফুর্তি করছে। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বিজয়ের লক্ষণ। সেকারণ আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিলেন। ফলে ঘুম থেকে উঠে প্রফুল্লচিত্তে সবাই যুদ্ধে জয়ের জন্য একাট্টা হয়ে দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেল।
আলী (রাঃ) বলেন যে, বদর যুদ্ধের রাতে এমন কেউ বাকী ছিল না যে, যিনি ঘুমাননি। কেবল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত। তিনি সারা রাত জেগে ছালাতে রত থাকেন। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বারবার স্বীয় প্রভুর নিকট দো’আ করতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ! যদি তুমি এই দলকে ধ্বংস করে দাও, তাহলে জনপদে তােমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না’। অতঃপর সকাল হলে তিনি সবাইকে ডাকেন, আল্লাহর বান্দারা! ছালাত’। অতঃপর সবাই জমা হ’লে তিনি ফজরের জামা’আত শেষে সবাইকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেন। (আহমাদ, হা/২০৮, ৯৪৮)
আলী (রাঃ) বলেন, বদরের যুদ্ধের দিন আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের মধ্যে শক্রর সর্বাধিক নিকটবর্তী ছিলেন এবং আমাদের সকলের চাইতে সর্বাধিক বড় যােদ্ধা ছিলেন। (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ)।
মাক্কী বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা:
প্রত্যুষে কুরায়েশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হোম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরায়েশ সেনা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর টিলার সম্মুখস্থ পানির হাউযের দিকে অগ্রসর হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হ’ল। একমাত্র হাকীম পান করেননি, তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি পাক্কা মুসলিম হয়ে যান (ইবনু হিশাম ১/৬২২)।
কুরায়েশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বােকামিতে দুঃখেক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ও সংখ্যা নিরূপণের জন্য ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারােহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শাে বা তার কিছু কমবেশী হবে।
তবে আরেকটু সময় দাও, আমি দেখে আসি, ওদের পিছনে কোন সাহায্যকারী সেনাদল আছে কি-না। সে আবার ছুটলাে এবং বহু দূর ঘুরে এসে বলল, ওদের পিছনে কাউকে দেখলাম না। তবে সে বলল ‘হে কুরায়েশগণ, বিপদ এসেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। তাদের সাথে কোন শক্তি নেই বা কোন আশ্রয় নেই কেবল তাদের তরবারি ছাড়া’।
অতএব “আল্লাহর কসম, তােমাদের একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত তাদের একজন নিহত হবে’। অতএব তােমরা চিন্তা-ভাবনা কর’ (ইবনু হিশাম ১/৬২২)।
তার এ রিপাের্ট শুনে হাকীম বিন হোম বয়ােজ্যেষ্ঠ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী’আহ্বর কাছে এসে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার ব্যাপারে বুঝাতে লাগলেন। তিনি রাজি হলেন। এমনকি ইতিপূর্বে নাখলা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে রজবের শেষ দিনে হারাম মাসে নিহত আমর ইবনুল হারামীর রক্তমূল্য তিনি নিজ থেকে দিতে চাইলেন।
অতঃপর উৎবা দাড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায় তােমাদের কোন গৌরব নেই। কেননা তাতে তােমরা তােমাদের চাচাতাে ভাই বা খালাতাে ভাই বা মামাতাে ভাইয়ের বা নিজ গােত্রের লােকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখবে, যা তােমাদের কাছে মােটেই পসন্দনীয় হবে না। “অতএব তােমরা ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ ও গােটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে মেরে ফেলে, তবে সেটা তাই-ই হবে, যা তােমরা চেয়েছিলে। আর যদি তা না হয়, তাহলে সে তােমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এজন্য যে, তােমরা তার সাথে সেরূপ ব্যবহার করােনি, যেরূপ তােমরা চেয়েছিলো।
এদিকে হাকীম বিন হোম আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিজের ও উৎবার মতামত ব্যক্ত করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য তাকে অনুরােধ করলেন। এতে আবু জাহল ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর কসম! উৎবার উপরে মুহাম্মাদের জাদু কার্যকর হয়েছে।
কখনােই না। আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে একটা ফায়ছালা করে দেন। তিনি বললেন, “এতক্ষণে বুঝলাম যে, উৎবার পুত্র আবু হুযায়ফা যে মুসলমান হয়ে হিজরত করে আগে থেকেই মুহাম্মাদের দলে রয়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে সে নিহত হবে, সেই ভয়ে উৎবা যুদ্ধ না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে।
হাকীমের কাছ থেকে আবু জাহলের এইসব কথা শুনে উৎবার বিচারবুদ্ধি লােপ পেল। তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠলাে। ক্ষুব্ধ চিঙ্কারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। ওদিকে আবু জাহল ‘আমের ইবনুল হারামীকে গিয়ে বললেন, দেখছ কি তােমার ভাই আমরের রক্তের প্রতিশােধ আর নেওয়া হল না। ঐ দেখ কাপুরুষ উৎবা পালাচ্ছে। শীগ্রই উঠে আর্তনাদ শুরু কর। মুহূর্তের মধ্যে মুশরিক শিবিরে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। রণােন্মত্ত কুরায়েশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ছুটে চলল (ইবনু হিশাম ১/৬২৩)।
এ সময় রাসূল (ছাঃ) লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী’আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহলে তারা সঠিক পথে থাকতাে’ (ইবনু হিশাম ১/৬২১)।
মুসলিম বাহিনী সারিবদ্ধ হল:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের বাহিনীকে দ্রুত প্রস্তুত ও সারিবদ্ধ করে ফেললেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। ব্যাপকহারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ তীর ছুঁড়বে না এবং তােমাদের উপরে তরবারি ছেয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তরবারি চালাবে না’। তিনি আরও বলেন, বনু হাশেমকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ নয়।
অতএব তাদের কোন ব্যক্তি সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন কেউ আঘাত না করে। আব্বাসকে যেন হত্যা না করা হয়। অনুরূপভাবে আবুল বাখতারী বিন হেশামকেও হত্যা করাে না। কেননা এরা মক্কায় আমাদের কোনরূপ কষ্ট দিত না। বরং সাহায্যকারী ছিল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) টিলার উপরে সামিয়ানার নীচে নিজ স্থানে চলে যান।
যুদ্ধ শুরু:
২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান শুক্রবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয় (ইবনু হিশাম ১/৬২৬)। ইতিমধ্যে কুরায়েশ পক্ষের জনৈক হঠকারী আসওয়াদ বিন আব্দুল আসাদ আল-মাখযুমী দৌড়ে এসে বলল, আমি এই হাউয থেকে পানি পান করব অথবা একে ভেঙ্গে ফেলব অথবা এখানেই মরব’। তখন হামযা (রাঃ) এসে তার পায়ে আঘাত করলেন। এমতাবস্থায় সে পা ঘেঁষতে ঘেষতে হাউযের দিকে এগােতে লাগল। হামযা তাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করলে সে হাউযেই মরে পড়ল ও তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হ’ল। এরপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলাে এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীর যােদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহ্বান করল।
তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারােহী বীর উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী’আহ এবং অলীদ বিন উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হ’তে মু’আয ও মু’আব্বি বিন আফরা কিশোর দুই ভাই এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা সহ তিনজন আনছার তরুণ বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরায়েশ পক্ষ বলে উঠলাে হে মুহাম্মাদ! আমাদের স্বগােত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও’। তখন রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযাহ, হে আলী তােমরা যাও। অতঃপর আলী তার প্রতিপক্ষ অলীদ বিন উব্বাহকে, হামযাহ তার প্রতিপক্ষ শায়বাহ বিন রাবী’আহকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। ওদিকে বৃদ্ধ ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবী’আহর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হ’লেন। তখন আলী ও হামযাহ তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাকে শেষ করে দেন ও ওবায়দাহকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে যুদ্ধশেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন ওবায়দাহ শাহাদাত বরণ করেন (আবুদাঊদ হা/২৬৬৫)।
প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীর যােদ্ধা ও গােত্র নেতাকে হারিয়ে কুরায়েশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় রাসূল (ছাঃ) শত্রুদের যথাসম্ভব দূরে রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন, ‘যখন তারা তােমাদের উপরে ঝাপিয়ে পড়বে, তখন তােমরা তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ কর এবং এর মাধ্যমে প্রতিযােগিতা কর’ (বুখারী হা/৩৯৮৪)।
অতঃপর তিনি এক মুষ্টি বালু হাতে নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, ‘চেহারাগুলাে বিকৃত হৌক। ফলে শত্রুবাহিনীর মুশরিকদের এমন কেউ থাকলাে না, যার চোখে ঐ বালু প্রবেশ করেনি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য। তাই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, তুমি যখন বালু নিক্ষেপ করেছিলে, প্রকৃতপক্ষে তা তুমি নিক্ষেপ করােনি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৬৬৮; আনফাল ৮/১৭)।
নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর একটি মু’জেযা ও অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা তিনি হােনায়েন যুদ্ধেও করেছিলেন (মুসলিম হা/১৭৭৭)।
বালু নিক্ষেপের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় বাহিনীকে নির্দেশ দেন, ‘তােমরা এগিয়ে চলাে জান্নাতের পানে, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত’ (মুসলিম হা/১৯০১)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই আহ্বান। মুসলমানদের দেহমনে ঈমানী বিদ্যুতের চমক এনে দিল।
অতঃপর তিনি বললেন, ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, যে ব্যক্তি আজকে দৃঢ়পদে নেকীর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে, পিছপা হবে না, সর্বদা সম্মুখে অগ্রসর হবে, অতঃপর যদি সে নিহত হয়, তবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’ (ইবনু হিশাম ১/৬২৭)।
জান্নাত পাগল মুমিন মৃত্যুকে পায়ে দলে শতগুণ শক্তি নিয়ে সম্মুখে আগুয়ান হ’ল ও তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক আনছার ছাহাবী উমায়ের বিন হােমাম বাখ বাখ’ বলে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জান্নাতবাসী হতে চাই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী’। একথা শুনে ছাহাবী থলি হ’তে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু দ্রুত তিনি বলে উঠলেন, যদি আমি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে সেটাতাে দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে’ বলেই সমস্ত খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন (মুসলিম হা/১৯০১)।
যুদ্ধের প্রতীক চিহ্ন:
বিভিন্ন যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করতেন। যেমন বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রতীক চিহ্ন ছিল, (আহাদ, আহাদ)। মক্কা বিজয়, হােনায়েন এবং ত্বায়েফ যুদ্ধে মুহাজিরদের প্রতীক ছিল “হে বনু আব্দুর রহমান। খাযরাজদের প্রতীক ছিল “হে বনু আব্দুল্লাহ’! এবং আউসদের প্রতীক ছিল “হে বনু ওবায়দুল্লাহ’ (ইবনু হিশাম ২/৪০৯)
এতে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছাড়াও অন্যান্য দলের বিশেষ পতাকা ছিল। এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, পরিচিতির জন্য বিশেষ প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করা যায়। যাকে ‘ব্যাজ’ (Badge) কিংবা মনােগ্রাম (Monogram) ইত্যাদি বলা হয়।
ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দু’জনেরই মাত্র দুটি ঘােড়া ছিল। পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন কৃায়েস বিন আবু ছাছা’আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা’দ ইবনু মু’আয। (রাঃ) অথবা হুবাব ইবনুল মুনযির। উভয় পতাকাই ছিল কালাে রংয়ের। আর সার্বিক কম্যাণ্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। (আর-রাহীক ২০৪-০৫ পৃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২-১৩)
ফেরেশতাগণের অবতরণ:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, বদরের যুদ্ধে ব্যতীত অন্য কোন যুদ্ধে ফেরেশতারা যােগদান করেননি (ইবনু কাছীর)।
এ সময় আয়াত নাযিল হ’ল- ‘যখন তােমরা তােমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তােমাদের দো’আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, আমি তােমাদেরকে সাহায্য করব এক হাযার ফেরেশতা দিয়ে, যারা ধারাবাহিকভাবে অবতরণ করবে (আনফাল ৮/৯)।
উল্লেখ্য যে, সুরা আনফাল ৯ আয়াতে ‘এক হাযার’, আলে ইমরান ১২৪ ও ১২৫ আয়াতে যথাক্রমে ‘তিন হাযার’ ও ‘পাঁচ হার ফেরেশতা অবতরণের কথা বলা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, “এক হাযার সংখ্যাটি তিন হাযার বা তার অধিক সংখ্যাকে নিষেধ করে না। কেননা উক্ত আয়াতের শেষে যে শব্দ এসেছে তার অর্থ ধারাবাহিকভাবে আগত’। অতএব আল্লাহর হুকুমে যত হাযার প্রয়ােজন, তত হাযার ফেরেশতা নাযিল হবে’। বস্তুতঃ সংখ্যায় বেশী বলার উদ্দেশ্য মুসলিম বাহিনীকে অধিক উৎসাহিত করা এবং বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করা।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর তিনি জেগে উঠে বললেন, ‘ঐ যে জিব্রীল যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘােড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি তাঁবুর বাইরে এসে বললেন, ‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাবে’ (কামার ৫৪/৪৫; বুখারী, হা/৩৯৫৩)।
ফেরেশতাগণের যুদ্ধে যােগদান:
মুসলিম বাহিনীর এই হামলার প্রচণ্ডতার সাথে সাথে যােগ হয় ফেরেশতাগণের আগমন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, যখন তােমাদের পালনকর্তা ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন যে, আমি তােমাদের সাথে রয়েছি। অতএব তােমরা ঈমানদারগণের চিত্তকে দৃঢ় রাখাে। আমি সত্বর অবিশ্বাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে দেব। কাজেই তােমরা গর্দানের উপর আঘাত হানাে এবং তাদের প্রত্যেক জোড়ায় জোড়ায় মারাে’। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হয়েছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তিদাতা” (আনফাল ৮/১২-১৩)।
ইকরিমা বিন আবু জাহল বলেন, ঐদিন আমাদের লােকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেত, অথচ দেখা যেতাে না কে মারলাে (তাবাকাত ইবনু সা’দ)।
আবুদাউদ আল-মাযেনী বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হব। ইতিমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল’। রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আব্বাস যিনি বাহ্যিকভাবে মুশরিক বাহিনীতে ছিলেন, জনৈক আনছার তাকে বন্দী করে আনলে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। বরং যে ব্যক্তি বন্দী করেছে, তাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি একজন চুল বিহীন মাথাওয়ালা ও সুন্দর চেহারার মানুষ এবং বিচিত্র বর্ণের একটি সুন্দর ঘােড়ায় তিনি সওয়ার ছিলেন। আনছার যােদ্ধা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমিই এনাকে বন্দী করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত আনছারকে বললেন, – ‘চুপ কর। আল্লাহ এক সম্মানিত ফেরেশতা দ্বারা তােমাকে সাহায্য করেছেন’ (আহমাদ, হা/৯৪৮)।
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, ফেরেশতারা কোন মুশরিকের উপরে আক্রমণ করার ইচ্ছা করতেই আপনাআপনি তার মস্তক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, ঐ দিন একজন মুসলিম সেনা তার সম্মুখের মুশরিককে মারতে গেলে শাণিত তরবারির ও ঘােড়ার আওয়ায শােনেন। তিনি ফেরেশতার আওয়ায শুনেছেন যে, তিনি বলছেন ‘হায়যুম আগে বাড়াে’ (‘হায়্যুম’ হ’ল ফেরেশতার ঘােড়র নাম)। অতঃপর ঐ মুশরিক সেনাকে তিনি সামনে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে দেখেন। তিনি দেখলেন যে, তরবারির আঘাতের ন্যায় তার নাক ও মুখমণ্ডল বিভক্ত হয়ে গেছে। উক্ত আনছার ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বলেন, ‘তুমি সত্য বলেছ। ওটি তৃতীয় আসমান থেকে সরাসরি সাহায্যের অংশ (মুসলিম, হা/১৭৬৩)।
উপরােক্ত ঘটনাবলী এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তারাও যেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন।
ফেরেশতা নাযিলের উদ্দেশ্য:
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘(তােমাদের নিকটে ফেরেশতা প্রেরণের বিষয়টি ছিল) কেবল তােমাদের জন্য সুসংবাদ হিসাবে এবং যাতে তােমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। বস্তুতঃ সাহায্য কেবলমাত্র মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্র পক্ষ হতেই এসে থাকে (আলে ইমরান ৩/১২৬)।
এর দ্বারা একথা বুঝানাে হয়েছে যে, মুসলিম বাহিনী যেন এ বিশ্বাস দৃঢ় রাখে যে, ফেরেশতারা তাদের সাহায্যার্থে প্রস্তুত হয়ে পাশেই আছে। প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনােবলকে বর্ধিত করা, ফেরেশতাদের দ্বারা যুদ্ধ করানাে নয়। কেননা তারা সরাসরি জিহাদ করলে মুমিনদের কোন ছওয়াব থাকে না। তাছাড়া সেটা হ’লে তাে এক হাযার, তিন হাযার বা পাঁচ হাযার কেন, একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল কুরায়েশ বাহিনীকে খতম করার জন্য। যেভাবে জিব্রীল (আঃ) একাই দূতের কওমকে তাদের নগরীসহ শূন্যে তুলে উপুড় করে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন আল্লাহর হুকুমে (হূদ ১১/৮২; হিজর ১৫/৭৩-৭৪)।
এ জগতে যুদ্ধ ও জিহাদের দায়িত্ব মানুষকে অর্পণ করা হয়েছে। যাতে তারা তার সাওয়াব ও উচ্চ মর্যাদা লাভে ধন্য হয়। ফেরেশতা বাহিনী দ্বারা যদি দেশ জয় করা বা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা আল্লাহর ইচ্ছা হত, তাহলে পৃথিবীতে কাফেরদের রাষ্ট্র দূরে থাক, তাদের অস্তিত্বই থাকতাে না। বরং আল্লাহর বিধান এই যে, দুনিয়াতে কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষ চলতেই থাকবে।
ঈমানদারগণ সর্বদা আল্লাহর সাহায্য পাবেন, কিন্তু কাফেররা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে এবং ইহকালে ও পরকালে তারা ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হবে। নমরূদ ও ইবরাহীম, ফেরাউন ও মূসা কি এর বাস্তব উদাহরণ নয়? আজও ফেরাউন ও মূসার দ্বন্দ্ব চলছে এবং কিয়ামত অবধি তা চলবে।
মাক্কী বাহিনীর পলায়ন:
মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লােকদের উদ্দেশ্যে জোরালাে ভাষণ দিয়ে বলেন, সোরাক্বার পলায়নে তােমরা ভেঙ্গে পড়াে না। সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। উৎবা, শায়বা ও অলীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়াের মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও উয্যার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তােমরা ওদেরকে মেরাে না। বরং ধরাে এবং বেঁধে ফেল”। কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হ’ল।
বর্ষিয়ান ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন আওফকে আনছারদের বনু সালামাহ গােত্রের কিশাের দু’ভাই মু’আয ও মু’আউভি বিন আফরা পৃথকভাবে এসে জিজ্ঞেস করল ‘চাচাজী! আবু জাহল-কে দেখিয়ে দিন। সে নাকি আমাদের রাসূলকে গালি দেয়? আব্দুর রহমান বিন আওফ বলেন, আমি ওদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছােড়বান্দা। ফলে বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তখন ওরা দু’জন তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু’আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু’আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে হেঁচকা টানে সেটাকে নিজ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছােট ভাই মু’আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হলে তারা উভয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে গর্বভরে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তােমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তােমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ।” অবশ্য এই যুদ্ধে মু’আউভি বিন আফরা পরে শহীদ হন এবং মু’আয বিন আফরা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকাল (২৩-৩৫ হি.) পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন (মুসলিম, হা/১৮০০)।
পরে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ গিয়ে দেখেন যে, আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে, তােমরা কি এই ব্যক্তির চাইতে বড় কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে পেরেছ? ওহ! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষাদের বদলে অন্য কেউ হত্যা করতাে (বুখারী, হা/৪০২০)। উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসউদ (রাঃ) মক্কায় ওক্বা বিন আবু মু’আইত্বের বকরীর রাখাল ছিলেন (আল-বিদায়াহ ৬/১০২)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইবনু মাসউদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আল্লাহ তােকে লাঞ্ছিত করুন রে আল্লাহর দুশমন!” জবাবে আবু জাহল বলে ওঠে, ‘কেন তিনি আমাকে লাঞ্ছিত করবেন? আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তিকে তােমরা হত্যা করেছ কি?” (মুসলিম, হা/১৮০০)
এখন বল, ‘আজ কারা জিতলাে’। ইবনু মাসউদ বললেন, ‘আজকের জয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর জন্য’। বলেই তার মাথাটা কেটে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাযির হলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা হ’ল আল্লাহর দুশমন আবু জাহলের মাথা। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন, আল্লাহর কসম? যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি বললাম, হ্যা। আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। অতঃপর আমি তাঁর সামনে মাথাটি রেখে দিলাম তখন তিনি “আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন। এভাবে মক্কার বড় ত্বাগূতটা শেষ হয়।
তিনদিন অবস্থানের পর বিদায়কালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার মৃত নেতাদের উদ্দেশ্যে। কুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে একে একে পিতা সহ তাদের নাম ধরে ডেকে বলেন, “হে অমুকের পুত্র অমুক! হে অমুকের পুত্র অমুক! তােমরা কি এখন বুঝতে পারছ যে, আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করলে তােমরা আজ খুশী হ’তে? নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে (বিজয়ের) ওয়াদা দিয়েছিলেন, আমরা তা সত্যরূপে পেয়েছি। তােমরা কি তা সত্যরূপে পেয়েছ যা তােমাদের প্রতিপালক তােমাদেরকে (আযাবের) ওয়াদা করেছিলেন। এ সময় ওমর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন দেহগুলির সাথে কথা বলছেন, যাদের মধ্যে রূহ নাই। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তার কসম করে বলছি, তােমরা তাদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি (বুখারী হা/৩৯৭৬)।
বদর যুদ্ধের ফলাফল:
এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার মােট ১৪জন শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হন। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়।
যাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহলসহ ১৪জন নেতার ১১ জন ছিল। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান (মৃ. মদীনায় ৩০ অথবা ৩৪ হি.), জুবায়ের বিন মুত্ব’ইম (মৃ. ৫৭ হি.) ও হাকীম বিন হোম (মৃ. ৫৪ হি.) মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন এবং তাদের ইসলাম আমৃত্যু সুন্দর ছিল।
উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুত্বইম ও আবু লাহাব বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। আবু লাহাব বদর যুদ্ধের সপ্তাহকাল পরে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
বদর যুদ্ধে শহীদ সাহাবীদের নাম:
বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর যে ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন, তন্মধ্যে মুহাজির ছয় জন হলেন,
(১) মিহজা, যিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বারে মুক্তদাস ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর প্রথম শহীদ।
(২) বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব থেকে উবায়দাহ ইবনুল হারিছ বিন মুত্ত্বালিব। শত্রু পক্ষের নেতা উহ্বাহ বিন রাবী’আহ তার পা কেটে দেন। পরে ‘ছাফরা’ গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
(৩) বনু যােহরা থেকে উমায়ের বিন আবু ওয়াককাছ । যিনি সা’দ বিন আবু ওয়াকক্কাছের ভাই ছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সের তরুণ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ) তাকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি কাঁদতে থাকেন। ফলে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি শহীদ হয়ে যান (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬০৬১)।
(৪) মুহাজিরগণের মিত্র যুশ-শিমালাইন বিন ‘আব্দে আমর আল-খুযাঙ্গ।
(৫) বনু ‘আদীর মিত্র ‘আক্লে বিন বুকায়ের।
(৬) বনুল হারেছ বিন ফিহর থেকে ছাফওয়ান বিন বায় ।
অতঃপর আনছারদের মধ্যেকার আট জন হলেন;
(১) বনু নাজ্জার থেকে হারিছাহ বিন সুরাকাহ।
(২-৩) বনু গানাম থেকে ‘আফার দুই পুত্র ‘আওফ ও মু’আউভিয।
(৪) বনুল হারেছ বিন খাযরাজ থেকে ইয়াযীদ বিন হারেছ।
(৫) বনু সালামাহ থেকে উমায়ের বিন হুমাম।
(৬) বনু হাবীব থেকে রাফে বিন মু’আল্লা।
(৭) বনু আমর বিন আওফ থেকে সা’দ বিন খায়ছামা এবং
(৮) মুবাশশির বিন আব্দুল মুনযির (ইবনু হিশাম ১/৭০৬-০৮)।
নিহত কুরায়েশ নেতৃবৃন্দের কয়েকজন:
বদর যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হন (ইবনু হিশাম ১৭১৪)। নিহতদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হ’লেন,
(১-৫) বনু আব্দে শামস গােত্রের উদ্বাহ ও তার পুত্র অলীদ এবং ভাই শায়বাহ বিন রাবী’আহ, হানযালা বিন আবু সুফিয়ান এবং উৎবা বিন আবু মু’আইত্ব। যাকে পরে হত্যা করা হয়।
(৬) বনু মাখযুম গােত্রের আবু জাহল আমর ইবনু হিশাম।
(৭-৮) বনু জুমাহ গােত্রের উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহী ও তার পুত্র আলী।
(৯) বনু আসাদ গোত্রের আবুল বাখতারী ‘আছ বিন হিশাম
(১০) নওফাল বিন খুওয়াইলিদ বিন আসাদ (কুরাইশের শয়তানদের অন্যতম)।
(১১) বনু নওফাল গােত্রের তু’আইমা বিন ‘আদী। জুবায়ের বিন মুত্বইম-এর চাচা।
(১২) বনু আব্দিদার গােত্রের ন্যর বিন হারেছ। যাকে পরে হত্যা করা হয়।
(১৩-১৪) বনু সাহম গােত্রের বাইহ ও মুনাব্বিহ ইবনুল হাজ্জাজ দুই ভাই (ইবনু হিশাম ১/৭০৮-১৩)।
প্রসিদ্ধ কুরায়েশ বন্দীদের কয়েকজন:
(১) বনু হাশেম গােত্র থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব।
(২) চাচাতাে ভাই ‘আক্বীল বিন আবু ত্বালিব
(৩) নওফাল বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব
(৪) বনু আব্দে শাম্স গােত্রের আমর বিন আবু সুফিয়ান
(৫) রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা ‘আব্দে শামস গােত্রের আবুল আছ বিন রবী’। ইনি যয়নাবের স্বামী ছিলেন। তার বিনিময় মূল্য হিসাবে বিবাহকালে খাদীজা (রাঃ)-এর দেওয়া কণ্ঠহার দেখে রাসূল (ছাঃ) অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। পরে তাকে যয়নাবকে ফেরত দেওয়ার শর্তে কোনরূপ বিনিময় মূল্য ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয় (ইবনু হিশাম ১৬৫২-৫৩)।
(৬) বনু জুমাহ গােত্রের আমর বিন উবাই বিন খালাফ (ইবনু হিশাম ২/৩-৮)। ইবনু হিশাম তার তালিকায় আব্বাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নাম দেননি। কারণ তিনি আগে থেকেই ‘মুসলিম’ ছিলেন। কিন্তু সম্প্রদায়ের ভয়ে তার ইসলাম গােপন রেখেছিলেন (ইবনু হিশাম ২/৩)।
মক্কায় পরাজয়ের খবর ও তার প্রতিক্রিয়া:
হায়সুমান বিন আব্দুল্লাহ আল-খুঈ সর্বপ্রথম মক্কায় পরাজয়ের খবর পৌঁছে দেয়। এ খবর তাদের উপরে এমন মন্দ প্রভাব ফেলল যে, তারা শােকে-দুঃখে পাথর হয়ে গেল এবং সকলকে বিলাপ করতে নিষেধাজ্ঞা জারী করল। যাতে মুসলমানেরা তাদের দুঃখ দেখে আনন্দিত হবার সুযােগ না পায়।
যুদ্ধ ফেরত ভাতিজা আবু সুফিয়ান বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবকে দেখে আবু লাহাব সাগ্রহে যুদ্ধের খবর কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা এমন একটা দলের মুকাবিলা করেছি, যাদেরকে আমরা আমাদের কাধগুলি পেতে দিয়েছি। আমাদের মুকাবিলা এমন কিছু শুভ্রবসন লােকের সঙ্গে হয়েছিল, যারা আসমান ও যমীনের মাঝখানে সাদা-কালাে মিশ্রিত ঘােড়র উপরে সওয়ার ছিল। আল্লাহর কসম! না তারা কোন কিছুকে ছেড়ে দিচ্ছিল, না কেউ তাদের মুকাবিলায় দাঁড়াতে পারছিল’। একথা শুনে পাশেই দাঁড়ানাে আবু রাফে’, যিনি আব্বাস-এর গােলাম ছিলেন এবং মুসলমান ছিলেন, তিনি বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কসম! ওঁরা ফেরেশতা’।
একথা শুনে ক্ষুব্ধ নেতা আবু লাহাব তার গালে ভীষণ জোরে এক চড় বসিয়ে দিল। আবু লাহাব আবু রাফে’-কে মাটিতে ফেলে দিয়ে মারতে লাগল। তখন আব্বাস এর স্ত্রী উম্মুল ফযল (রাঃ) এসে তাবুর একটা খুঁটি নিয়ে আবু লাহাবকে ভীষণ জোরে মার দিয়ে বললেন, “ওর মনিব বাড়ী নেই বলে তুমি ওকে দুর্বল ভেবেছ?’ এতে লজ্জিত হয়ে আবু লাহাব উঠে গেল।
এর মাত্র সাতদিনের মধ্যেই আল্লাহর হুকুমে সে আদাসাহ নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেহ পচে গলে মারা গেল। গুটি বসন্তের ন্যায় এই রােগকে সেযুগে মানুষ কু-লক্ষণ ও সংক্রামক ব্যাধি বলে জানত। ফলে পরিবারের লােকেরা তাকে ছেড়ে যায় এবং সে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করে। এ অবস্থায় তিনদিন লাশ পড়ে থাকলেও কেউ তার কাছে যায়নি। অবশেষে একজন লােকের সহায়তায় তার দুই ছেলে তার লাশ পাহাড়ের মাথায় নিয়ে একটা লাঠি দিয়ে ঠেলে গর্তে ফেলে তার উপর মাটি ও পাথর ছুঁড়ে পুঁতে দিল দুর্গন্ধের ভয়ে। এইভাবে এই দুরাচার দুনিয়া থেকে বিদায় হ’ল। ছাফা পাহাড়ের ভাষণের দিন রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বদা তুমি ধ্বংস হও’ বলার ১৫ বছর পরে তার এই পরিণতি হয় ।
মদীনায় বিজয়ের খবর:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারীকে মদীনার উচ্চ ভূমিতে এবং যায়েদ বিন হারেছাহকে নিম্নভূমিতে পাঠিয়ে দেন মদীনায় দ্রুত বিজয়ের খবর পৌছানাের জন্য। ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর কন্যা ও হযরত ওছমানের স্ত্রী রুক্বাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি সমান করা হচ্ছিল। যার অসুখের কারণে রাসূল (ছাঃ) ওছমান ও উসামা বিন যায়েদকে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন তার সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য (ইবনু হিশাম, ১/৬৪২)।
অন্য দিকে ইহুদী ও মুনাফিকরা রাসূল (ছাঃ)-এর পরাজয় এমনকি তাঁর নিহত হবার খবর আগেই রটিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর নিশ্চিত খবর জানতে পেরে মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মদীনা মুখরিত করে তােলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে অভ্যর্থনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন (আর-রাহীক ২২৭ পৃঃ)।
গণীমত বণ্টন:
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন যে, এরি মধ্যে গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়, যা এক সময়ে চরমে ওঠে। যারা শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছিল ও কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দী করেছিল, তারা তার সব মাল দাবী করল। আরেক দল যারা গণীমত জমা করেছিল, তারা সব মাল তাদের বলে দাবী করল। আরেক দল যারা রাসূল (ছাঃ)-কে পাহারা দিয়ে তাকে হেফাযত করেছিল, তারাও সব নিজেদের বলে দাবী করল।
এ সময় সূরা আনফাল ১ম আয়াত নাযিল হয় ‘লােকেরা তােমাকে প্রশ্ন করছে যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কে। বলে দাও, গণীমতের মাল সবই আল্লাহ ও তার রাসূলের। অতএব তােমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নাও। আর তােমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর যদি তােমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)। অতঃপর সেমতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন।
অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বদর থেকে রওয়ানা দিয়ে ছাফরা’ গিরি সংকট অতিক্রম করে একটি টিলার উপরে গিয়ে বিশ্রাম করেন এবং সেখানে বসে গণীমতের সমস্ত মালের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল সৈন্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন (আহমাদ, হা/২২৮১৪)।
যুদ্ধবন্দী হত্যা:
ছাফরা গিরিসংকটে কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী দুষ্টমতি ন্যর বিন হারিছকে রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশক্রমে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করেন। এই শয়তান ইরাকের ‘হীরা’ থেকে নাচগানে পারদর্শী সুন্দরী নর্তকীদের খরীদ করে এনে মক্কাবাসীদের বিভ্রান্ত করত। যাতে কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর কথা না শােনে ও কুরআন না শােনে। এরপর ‘ইরকু্য যাবিয়াহ’ নামক স্থানে পৌছে আরেক শয়তানের শিখণ্ডী উকবা বিন আবু মু’আইত্বকে হত্যার নির্দেশ দেন।
যে ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে কা’বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় গলায় চাদর পেঁচিয়ে এবং পরে মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৩৭৮, ৫২০)। একে মারেন আছেম বিন ছাবিত আনছারী (রাঃ), মতান্তরে হযরত আলী (রাঃ)। এই দু’জন ব্যক্তি বন্দীর মর্যাদা পাবার যােগ্য ছিল না। কেননা তারা ছিল আধুনিক পরিভাষায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী
যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌছে। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তাঁর আদেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান (ইবনু হিশাম ১/৬৪৪-৪৫)। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য।
অতঃপর তিনি ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নছীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হতে পারে। কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হন্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিলেন।
জামাতা আবুল আছ সহ কয়েকজনকে রক্তমূল্য ছাড়াই মুক্তি দেন। আবুল আছ ছিলেন খাদীজার সহােদর বােনের ছেলে এবং রাসুল-কন্যা যয়নবের স্বামী। ফিদইয়া দিতে অক্ষম কয়েকজনকে মাথা প্রতি ১০ জনকে লেখাপড়া শিখানাের বিনিময়ে। মদীনাতেই রেখে দেন। তাদের মেয়াদ ছিল উত্তম রূপে পড়া ও লেখা শিক্ষা দান করা পর্যন্ত। এর দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর আকুল আগ্রহের প্রমাণ মেলে। যা কোন যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ইতিহাসে ছিল নীরবিহীন। ওছমান (রাঃ) সহ নয় জন ছাহাবীকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও গণীমতের অংশ দেন তাদের যথার্থ ওযর ও অন্যান্য সহযােগিতার কারণে।
বন্দীমুক্তির পরের দিনই সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শের প্রতি আল্লাহর সমর্থন প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) ক্রন্দন করতে থাকেন। উক্ত আয়াতে বলা হয়,
‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তােমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। আল্লাহর পক্ষ হতে পূর্ব বিধান না থাকলে তােমরা যা গ্রহণ করেছ, তজ্জন্য তােমাদেরকে ভয়ংকর শাস্তি পাকড়াও করত” (আনফাল ৮/৬৭-৬৮)।
উপরােক্ত আয়াতে উল্লেখিত পূর্ব বিধানটি ছিল নিম্নরূপ:
অতঃপর যখন তােমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দান মার। অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ নাও। তােমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শত্রু অস্ত্র সমর্পণ করে.. (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)।
১ম ঈদুল ফিৎর:
ইবনু ইসহাক বলেন, রামাযানের শেষে বা শাওয়াল মাসে রাসূল (ছাঃ) বদর যুদ্ধ থেকে ফারেগ হন (ইবনু হিশাম ২/৪৩)। অতঃপর এমাসেই অর্থাৎ ২য় হিজরী সনে রামাযানের ছিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়। যাতে যাকাতের নিছাবসমূহ বর্ণিত হয় (মির’আত ৬/৩৯৯, ৩)। এটি আশ্রিত ও দুস্থ মুসলমানদের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেয়। অতঃপর এ বছর ১লা শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিৎরের উৎসব পালিত হয়, যা মুসলমানদের নিকটে সত্যিকারের বিজয়ােৎসবে পরিণত হয় (আর-রাহীক ২৩১-৩২ পৃঃ)।
বদর যুদ্ধের কুরআনের আয়াত:
বদর যুদ্ধ বিষয়ে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যার মধ্যে ১-৪৯ পর্যন্ত আয়াতগুলি কেবল বদর যুদ্ধ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। উক্ত সূরার ১ ও ৪১ আয়াতে গণীমত বণ্টনের নীতিমালা বর্ণিত হয়। তাছাড়া সেখানে মুসলমানদের দুর্বলতা এবং আল্লাহর গায়েবী মদদের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি উক্ত যুদ্ধের মহৎ উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা জাহেলী যুগের যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে যুদ্ধবন্দী বিষয়ক নীতি, চুক্তিবদ্ধ গােষ্ঠী ও চুক্তি বহির্ভূত মুমিনদের সাথে ব্যবহার। বিধি যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি ইসলাম যে কেবল একটি বিশ্বাসের নাম নয়, বরং একটি বাস্তব রীতি-নীতি সমৃদ্ধ সমাজ দর্শনের নাম, সেটাও ফুটিয়ে তােলা হয়েছে।
বদর যুদ্ধের গুরুত্ব:
(১) এটাই ছিল মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের সর্বপ্রথম ব্যাপকভিত্তিক সশস্ত্র সংঘর্ষ ।
(২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ
(৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। সেকারণ এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ইয়াওমুল ফুরকান” বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ফায়ছালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে।
(৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তােমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তােমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তােমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। উল্লেখ্য যে, বদর’ নামটি কুরআনে মাত্র একটি স্থানেই উল্লেখিত হয়েছে।
(৫) এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে হাদীছে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে গােপন কথা ফাঁস করে মক্কায় প্রেরিত হাতেব বিন আবু বালতা’আহ-এর পত্র ধরা পড়ার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করার অপরাধে ওমর (রাঃ) তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তােমরা যা খুশী কর। তােমাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে’। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) কাঁদতে থাকেন’ (বুখারী হা/৬২৫৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ বলে জনৈক ব্যক্তি মন্তব্য করলে তার উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি মিথ্যা বললে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। কেননা সে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, কখনােই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না ঐ ব্যক্তি যে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে।
বদর যুদ্ধের শিক্ষা কি?
(১) মক্কায় সামাজিক পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় সেখানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে মদীনায় পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবং এখানে সবাই রাসূল (ছাঃ)এর নেতৃত্ব মেনে নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ)-কে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও পরিবেশ না থাকলে যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে ছবর করতে হবে।
(২) বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। আবু জাহলকে বদরে মুকাবিলা না করলে সে সরাসরি মদীনায় হামলা করার দুঃসাহস দেখাত। যা ইতিপূর্বে তাদের একজন নেতা কুর বিন জাবের আল-ফিহরী সরাসরি মদীনার উপকণ্ঠে হামলা করে গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই।
(৩) সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের আধিক্য বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীলতাই হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার।
(৪) যুদ্ধের উদ্দেশ্য হতে হবে জান্নাত লাভ। যেটা যুদ্ধ শুরুর প্রথম নির্দেশেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। অতএব চিন্তাক্ষেত্রের যুদ্ধ হোক বা ময়দানের সশস্ত্র মুকাবিলা হৌক ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে আখেরাত। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাছিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্রশক্তি ব্যয়িত হবে না।
(৫) স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতামণ্ডলী পাঠিয়ে সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধে করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।
(৬) যুদ্ধে গণীমত লাভের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জিত হ’লেও তা কখনােই মুখ্য হবে না। বরং সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তার নির্দেশ অনুযায়ী আমীরের অনুগত থাকতে হবে। বদর যুদ্ধে গণীমত বণ্টন নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলেও তা সাথে সাথে নিষ্পত্তি হয়ে যায় রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে (আনফাল ৮/১)।
(৭) কাফিররা মূলত মুসলমানদের ঈমানী শক্তিকে ভয় পায়। এ কারণেই পরবর্তী ওহােদের যুদ্ধে তারা মহিলাদের সাথে করে এনেছিল। যাতে পুরুষেরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে না যায়।
(৮) বদর যুদ্ধের বড় শিক্ষা এই যে, কুফর ও ইসলামের মুকাবিলায় মুসলমান নিজের সীমিত শক্তি নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে ঝাপিয়ে পড়বে। আর এভাবেই চিরকাল ঈমানদার সংখ্যালঘু শক্তি বেঈমান সংখ্যাগুরু শক্তির উপরে বিজয়ী হয়ে থাকে (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। এ ধারা কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে ইনশাআল্লাহ।
উপসংহার
এই আর্টিকেলটি তৈরি করতে আমাকে সাহায্য করেছে জনাব মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব এর “সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (নবীদের কাহিনী-৩)” এবং জনাব সাদিক ফারহান এর “ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধ” এই বই গুলো। আমি চেষ্টা করেছি নির্ভুল ভাবে তুলে ধরার, এর পরও কোনো ভুল হয়ে থাকলে আশা করছি আপনারা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ইসলামের খেদমতে সবার কাছে শেয়ার করে দেওয়ার ও অন্যান্য আর্টিকেল গুলা পড়ার অনুরোধ রেখে শেষ করছি আজকের আলোচনা। আমাদের সাথে থাকার জন্য অসংখ ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন